
রহমান মৃধা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রণীত হয়েছিল একটি সংবিধান—যা শুধু কাগজের আইন নয়, বরং একটি নবজাত জাতির আত্মার দলিল। এই সংবিধানই দেশকে দিয়েছিল রাষ্ট্রের কাঠামো, আইনের ভিত্তি এবং ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি। বছরের পর বছর ধরে সময়ের দাবি ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এতে নানা সংশোধন ও সংযোজন যুক্ত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই সংবিধান আজ কতটা জীবন্ত ও কতটা কার্যকর? সবচেয়ে বড় কথা, কতজন নাগরিক বা নীতিনির্ধারক সত্যিকার অর্থে এর মূল দর্শন বুঝে কাজ করছেন?
সংবিধান ও আইন হলো রাষ্ট্রের প্রাণ—যা রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক জীবনের প্রতিটি দিককে দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু সেই প্রাণশক্তির উৎসকে আজ যেন আমরা ভুলে গেছি।
সংসদ ও নেতৃত্বের প্রশ্ন
যারা জনগণের ভোটে সংসদে গেছেন কিংবা রাজনৈতিক কৌশলে ক্ষমতা দখল করেছেন—তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। তবু প্রশ্ন জাগে—তারা কি সত্যিই জানেন সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শন কী? তারা কি বোঝেন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের গভীরতা কতটা? বাস্তবতা হলো—
ক. অনেক নির্বাচিত নেতা বা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি সংবিধান ও আইনের মৌল কাঠামো সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের কাছে সংবিধান কেবল একটি আনুষ্ঠানিক নথি, বাস্তব জীবনের নীতি নয়।
খ. যারা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছেন, তারা প্রায়শই দায়িত্ব ও নৈতিকতার চেয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার খেলায় বেশি মনোযোগী ছিলেন। ফলে রাষ্ট্রের নীতিগত ভিত্তি দুর্বল হয়েছে এবং সংবিধান কাগজে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
গ. জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও সেই ভোটের স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। যখন নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়, তখন সরকার নৈতিক বৈধতাও হারিয়েছে। ফলে, আইন ও সংবিধান তখন আর জনগণের হাতে থাকেনি—থেকেছে কেবল ক্ষমতার মঞ্চে।
প্রেক্ষাপট
জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় আলোচনার সূত্রপাত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শব্দ ঘুরছে—‘জুলাই সনদ’। বলা হচ্ছে, কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এই সনদ সাক্ষর করা হবে; বলা হচ্ছে, এটি হবে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচালনার একটি ভিত্তি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের সাধারণ মানুষ কি সত্যিই জানেন জুলাই সনদ কী? কেন এর গুরুত্ব এত অপরিসীম বলা হচ্ছে? আর যদি এটি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে কী নিশ্চয়তা রয়েছে যে এই সনদ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হলে বাতিল হবে না? এই প্রশ্নগুলো এখন রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে।
জুলাই সনদের মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য
জুলাই সনদ মূলত একটি নৈতিক ও নীতিগত চুক্তি। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে রাখার জন্য প্রণীত এক প্রস্তাবিত দলিল। এর লক্ষ্য হলো—
*প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা,
*রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনে সহজ ও শান্তিপূর্ণ রূপান্তর ঘটানো এবং
*নাগরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি ও নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো জানেন না, এই সনদের ভিতরে কী আছে, কিংবা এটি তাদের জীবনের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ও জনগণের প্রশ্ন
অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তখন জনগণের প্রত্যাশা—এই সরকারের কার্যক্রম হবে অরাজনৈতিক, স্বচ্ছ এবং জনগণের আস্থাভাজন। কিন্তু নাগরিকদের মনে আজও সন্দেহ রয়ে গেছে—
*এই সরকারের মেয়াদ শেষে জুলাই সনদের ধারাগুলো কি বাস্তবে টিকে থাকবে?
*নাকি আগের মতোই সব কিছু আবার পুরনো রাজনীতির কৌশলের কাছে হার মানবে?
এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে নাগরিক সচেতনতার ওপর। কারণ জনগণ যদি নিজেই না জানে কী তাদের অধিকার, তবে যেকোনো শাসকগোষ্ঠী তাদের বিভ্রান্ত করতে পারে।
রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে দূরত্ব: সমস্যার মূল উৎস
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে বিশ্বাসের ভাঙন। নাগরিকেরা মনে করেন, সংবিধান মানে ‘গুম, খুন, সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি’—কারণ গত ৫৪ বছরে রাজনীতিবিদরা এটাই তাদের শিখিয়েছে।
আমরা কখনো দেখিনি সংবিধান বাস্তবে মানুষের কল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। বরং দেখেছি সংবিধানকে ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অস্ত্র হিসেবে।
এই কারণেই আজ বাংলাদেশের নাগরিকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—সংবিধানকে পুনরায় নাগরিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনা।
প্রকৃত সংবিধান বোঝা ও শেখার জাতীয় প্রয়োজন
সংবিধান কোনো রাজনৈতিক দলের দলিল নয়; এটি পুরো জাতির জীবনের চুক্তিপত্র। এখানে নির্ধারিত আছে—রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি, নাগরিকের অধিকার এবং সরকারের দায়বদ্ধতা।
কিন্তু আমরা নাগরিকরা কখনো সেটি জানতে বা বুঝতে পারিনি।
তাই এখন প্রয়োজন এমন এক জাতীয় শিক্ষাভিত্তিক সচেতনতা অভিযান, যা সংবিধানকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে—
*স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়,
*মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা,
*ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে নাগরিক সমাবেশ পর্যন্ত।
সংবিধান শেখা মানে দেশ শেখা; দেশ শেখা মানে নিজের অধিকার ও দায়িত্ব শেখা।
জুলাই সনদ: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথনকশা
জুলাই সনদ আসলে একটি সম্ভাবনা—যদি এটি কাগজে নয়, বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি এমন একটি চুক্তি, যা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আইনের কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের নৈতিক অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
কিন্তু এর স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা নির্ভর করছে জনগণের ওপর। যদি জনগণ এই সনদের গুরুত্ব না বোঝে, যদি তারা এটি তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে না করে, তাহলে যেকোনো দল বা সরকার ক্ষমতায় এসে এটিকে বাতিল করে দিতে পারবে।
অতএব, জুলাই সনদকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হলো জনগণের অংশগ্রহণ ও সামাজিক চেতনা।
সচেতনতা ও নাগরিক প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা
আমাদের দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় ক্যাম্পেইন, যা পুরো সমাজকে নীতিগতভাবে পুনর্গঠন করবে। এই ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হবে—
১. নাগরিককে সংবিধানের ভাষা শেখানো,
২. জুলাই সনদের মূলনীতি ব্যাখ্যা করা,
৩. মানুষকে জানানো—তাদের ভোট, তাদের কণ্ঠ, তাদের অধিকারই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি।
এটি একটি সামাজিক আন্দোলন হতে হবে—যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে রাষ্ট্রের অংশ মনে করে, যেখানে সংবিধান কেবল একটি বই নয়, বরং এক জীবন্ত প্রতিশ্রুতি।
নেতৃত্ব ও জবাবদিহি: জনগণের নতুন দাবি
এখন সময় এসেছে নাগরিকদের স্পষ্টভাবে বলা, আমরা সেই নেতাকে চাই—ক. যিনি সংবিধান মেনে চলবেন, খ. যিনি জুলাই সনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং গ. যিনি দেশের ভবিষ্যৎকে রাজনীতির বাইরে রেখে পরিচালনা করতে পারবেন।
নেতৃত্ব মানে ক্ষমতা নয়, নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি। একজন প্রকৃত নেতা জানেন, সংবিধান তার চেয়েও বড়।
প্রবাসী নাগরিকের দৃষ্টিকোণ: প্রশ্ন ও আহ্বান
দূরদেশে থাকা প্রবাসী নাগরিকেরা প্রতিনিয়ত দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠান, দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখেন। কিন্তু তারা প্রশ্ন করেন—
*আমরা কি সত্যিই জানি সংবিধান কী?
*আমরা কি জানি কার হাতে আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপদ?
*আমরা কি জানি কোন নেতা সংবিধান মেনে দেশ চালাতে পারেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে না পেলে আমরা বারবার প্রতারিত হবো। তাই প্রবাসী নাগরিকদেরও এই সচেতনতার অংশ হতে হবে। তারা যেন দেশের মানুষকে, পরিবারের সদস্যদের সংবিধানের ভাষা বোঝাতে সহায়তা করেন।
নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ডাক
আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি মানবিক, নীতিনিষ্ঠ ও সচেতন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে জনগণই হবে সংবিধানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সংবিধান মানে আর গুম, খুন, সন্ত্রাস নয়; সংবিধান মানে ন্যায়, দায়িত্ব ও জনগণের মর্যাদা।
আমরা চাই—একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রচারণা। যা নাগরিকদের মনে করিয়ে দেবে জুলাই সনদের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি। যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ধর্মীয় মঞ্চ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। যাতে জাতি বুঝতে পারে—এটি কেবল সরকারের দলিল নয়, এটি জাতির চুক্তিপত্র।
শেষ পর্যন্ত আমরা ভোট দিতে চাই সেই মানুষকে—যারা সংবিধান মেনে দেশ পরিচালনা করার যোগ্য, যারা জনগণের চোখে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারেন, যারা রাষ্ট্রকে আবারও নাগরিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন।
এটাই হবে নতুন বাংলাদেশের প্রথম পদক্ষেপ। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে, যেখানে সংবিধানই হবে জীবনের মূল চেতনা।
আমরা প্রকৃত সংবিধান দেখতে, জানতে ও বুঝতে চাই। তারপর আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই নির্বাচনে, ভোট দিতে চাই তাকে—যিনি সংবিধান মেনে দেশ পরিচালনা করার যোগ্য।
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রণীত হয়েছিল একটি সংবিধান—যা শুধু কাগজের আইন নয়, বরং একটি নবজাত জাতির আত্মার দলিল। এই সংবিধানই দেশকে দিয়েছিল রাষ্ট্রের কাঠামো, আইনের ভিত্তি এবং ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি। বছরের পর বছর ধরে সময়ের দাবি ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এতে নানা সংশোধন ও সংযোজন যুক্ত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই সংবিধান আজ কতটা জীবন্ত ও কতটা কার্যকর? সবচেয়ে বড় কথা, কতজন নাগরিক বা নীতিনির্ধারক সত্যিকার অর্থে এর মূল দর্শন বুঝে কাজ করছেন?
সংবিধান ও আইন হলো রাষ্ট্রের প্রাণ—যা রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক জীবনের প্রতিটি দিককে দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু সেই প্রাণশক্তির উৎসকে আজ যেন আমরা ভুলে গেছি।
সংসদ ও নেতৃত্বের প্রশ্ন
যারা জনগণের ভোটে সংসদে গেছেন কিংবা রাজনৈতিক কৌশলে ক্ষমতা দখল করেছেন—তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। তবু প্রশ্ন জাগে—তারা কি সত্যিই জানেন সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শন কী? তারা কি বোঝেন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের গভীরতা কতটা? বাস্তবতা হলো—
ক. অনেক নির্বাচিত নেতা বা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি সংবিধান ও আইনের মৌল কাঠামো সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের কাছে সংবিধান কেবল একটি আনুষ্ঠানিক নথি, বাস্তব জীবনের নীতি নয়।
খ. যারা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছেন, তারা প্রায়শই দায়িত্ব ও নৈতিকতার চেয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার খেলায় বেশি মনোযোগী ছিলেন। ফলে রাষ্ট্রের নীতিগত ভিত্তি দুর্বল হয়েছে এবং সংবিধান কাগজে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
গ. জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও সেই ভোটের স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। যখন নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়, তখন সরকার নৈতিক বৈধতাও হারিয়েছে। ফলে, আইন ও সংবিধান তখন আর জনগণের হাতে থাকেনি—থেকেছে কেবল ক্ষমতার মঞ্চে।
প্রেক্ষাপট
জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় আলোচনার সূত্রপাত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শব্দ ঘুরছে—‘জুলাই সনদ’। বলা হচ্ছে, কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এই সনদ সাক্ষর করা হবে; বলা হচ্ছে, এটি হবে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচালনার একটি ভিত্তি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের সাধারণ মানুষ কি সত্যিই জানেন জুলাই সনদ কী? কেন এর গুরুত্ব এত অপরিসীম বলা হচ্ছে? আর যদি এটি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে কী নিশ্চয়তা রয়েছে যে এই সনদ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হলে বাতিল হবে না? এই প্রশ্নগুলো এখন রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে।
জুলাই সনদের মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য
জুলাই সনদ মূলত একটি নৈতিক ও নীতিগত চুক্তি। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে রাখার জন্য প্রণীত এক প্রস্তাবিত দলিল। এর লক্ষ্য হলো—
*প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা,
*রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনে সহজ ও শান্তিপূর্ণ রূপান্তর ঘটানো এবং
*নাগরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি ও নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো জানেন না, এই সনদের ভিতরে কী আছে, কিংবা এটি তাদের জীবনের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ও জনগণের প্রশ্ন
অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তখন জনগণের প্রত্যাশা—এই সরকারের কার্যক্রম হবে অরাজনৈতিক, স্বচ্ছ এবং জনগণের আস্থাভাজন। কিন্তু নাগরিকদের মনে আজও সন্দেহ রয়ে গেছে—
*এই সরকারের মেয়াদ শেষে জুলাই সনদের ধারাগুলো কি বাস্তবে টিকে থাকবে?
*নাকি আগের মতোই সব কিছু আবার পুরনো রাজনীতির কৌশলের কাছে হার মানবে?
এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে নাগরিক সচেতনতার ওপর। কারণ জনগণ যদি নিজেই না জানে কী তাদের অধিকার, তবে যেকোনো শাসকগোষ্ঠী তাদের বিভ্রান্ত করতে পারে।
রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে দূরত্ব: সমস্যার মূল উৎস
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে বিশ্বাসের ভাঙন। নাগরিকেরা মনে করেন, সংবিধান মানে ‘গুম, খুন, সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি’—কারণ গত ৫৪ বছরে রাজনীতিবিদরা এটাই তাদের শিখিয়েছে।
আমরা কখনো দেখিনি সংবিধান বাস্তবে মানুষের কল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। বরং দেখেছি সংবিধানকে ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অস্ত্র হিসেবে।
এই কারণেই আজ বাংলাদেশের নাগরিকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—সংবিধানকে পুনরায় নাগরিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনা।
প্রকৃত সংবিধান বোঝা ও শেখার জাতীয় প্রয়োজন
সংবিধান কোনো রাজনৈতিক দলের দলিল নয়; এটি পুরো জাতির জীবনের চুক্তিপত্র। এখানে নির্ধারিত আছে—রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি, নাগরিকের অধিকার এবং সরকারের দায়বদ্ধতা।
কিন্তু আমরা নাগরিকরা কখনো সেটি জানতে বা বুঝতে পারিনি।
তাই এখন প্রয়োজন এমন এক জাতীয় শিক্ষাভিত্তিক সচেতনতা অভিযান, যা সংবিধানকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে—
*স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়,
*মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা,
*ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে নাগরিক সমাবেশ পর্যন্ত।
সংবিধান শেখা মানে দেশ শেখা; দেশ শেখা মানে নিজের অধিকার ও দায়িত্ব শেখা।
জুলাই সনদ: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথনকশা
জুলাই সনদ আসলে একটি সম্ভাবনা—যদি এটি কাগজে নয়, বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি এমন একটি চুক্তি, যা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আইনের কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের নৈতিক অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
কিন্তু এর স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা নির্ভর করছে জনগণের ওপর। যদি জনগণ এই সনদের গুরুত্ব না বোঝে, যদি তারা এটি তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে না করে, তাহলে যেকোনো দল বা সরকার ক্ষমতায় এসে এটিকে বাতিল করে দিতে পারবে।
অতএব, জুলাই সনদকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হলো জনগণের অংশগ্রহণ ও সামাজিক চেতনা।
সচেতনতা ও নাগরিক প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা
আমাদের দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় ক্যাম্পেইন, যা পুরো সমাজকে নীতিগতভাবে পুনর্গঠন করবে। এই ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হবে—
১. নাগরিককে সংবিধানের ভাষা শেখানো,
২. জুলাই সনদের মূলনীতি ব্যাখ্যা করা,
৩. মানুষকে জানানো—তাদের ভোট, তাদের কণ্ঠ, তাদের অধিকারই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি।
এটি একটি সামাজিক আন্দোলন হতে হবে—যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে রাষ্ট্রের অংশ মনে করে, যেখানে সংবিধান কেবল একটি বই নয়, বরং এক জীবন্ত প্রতিশ্রুতি।
নেতৃত্ব ও জবাবদিহি: জনগণের নতুন দাবি
এখন সময় এসেছে নাগরিকদের স্পষ্টভাবে বলা, আমরা সেই নেতাকে চাই—ক. যিনি সংবিধান মেনে চলবেন, খ. যিনি জুলাই সনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং গ. যিনি দেশের ভবিষ্যৎকে রাজনীতির বাইরে রেখে পরিচালনা করতে পারবেন।
নেতৃত্ব মানে ক্ষমতা নয়, নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি। একজন প্রকৃত নেতা জানেন, সংবিধান তার চেয়েও বড়।
প্রবাসী নাগরিকের দৃষ্টিকোণ: প্রশ্ন ও আহ্বান
দূরদেশে থাকা প্রবাসী নাগরিকেরা প্রতিনিয়ত দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠান, দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখেন। কিন্তু তারা প্রশ্ন করেন—
*আমরা কি সত্যিই জানি সংবিধান কী?
*আমরা কি জানি কার হাতে আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপদ?
*আমরা কি জানি কোন নেতা সংবিধান মেনে দেশ চালাতে পারেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে না পেলে আমরা বারবার প্রতারিত হবো। তাই প্রবাসী নাগরিকদেরও এই সচেতনতার অংশ হতে হবে। তারা যেন দেশের মানুষকে, পরিবারের সদস্যদের সংবিধানের ভাষা বোঝাতে সহায়তা করেন।
নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ডাক
আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি মানবিক, নীতিনিষ্ঠ ও সচেতন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে জনগণই হবে সংবিধানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সংবিধান মানে আর গুম, খুন, সন্ত্রাস নয়; সংবিধান মানে ন্যায়, দায়িত্ব ও জনগণের মর্যাদা।
আমরা চাই—একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রচারণা। যা নাগরিকদের মনে করিয়ে দেবে জুলাই সনদের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি। যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ধর্মীয় মঞ্চ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। যাতে জাতি বুঝতে পারে—এটি কেবল সরকারের দলিল নয়, এটি জাতির চুক্তিপত্র।
শেষ পর্যন্ত আমরা ভোট দিতে চাই সেই মানুষকে—যারা সংবিধান মেনে দেশ পরিচালনা করার যোগ্য, যারা জনগণের চোখে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারেন, যারা রাষ্ট্রকে আবারও নাগরিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন।
এটাই হবে নতুন বাংলাদেশের প্রথম পদক্ষেপ। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে, যেখানে সংবিধানই হবে জীবনের মূল চেতনা।
আমরা প্রকৃত সংবিধান দেখতে, জানতে ও বুঝতে চাই। তারপর আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই নির্বাচনে, ভোট দিতে চাই তাকে—যিনি সংবিধান মেনে দেশ পরিচালনা করার যোগ্য।
*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]
জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো সংস্কার সফল হবে না। যেকোনো অনিয়ম প্রকাশ পেলে দ্রুত তদন্ত, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এগুলো শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং এক ধরনের মানসিক বার্তাও তৈরি করে যে অপরাধী রেহাই পায় না। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রধান শক্তি ছিল বিচারহীনতা।
১৯২০-এর দশকে ইউরোপ তখন যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতায় কাঁপছে। আইফেল টাওয়ার তখনো এতটা জনপ্রিয় নয়। রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বাড়ছে, আর শহরে গুজব—টাওয়ারটা নাকি ভেঙে ফেলা হতে পারে। এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন বিশ্বখ্যাত প্রতারক ভিক্টর লাস্টিগ।
এই সময় আমরা যে প্রার্থনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছি তা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি এক মানবিক আবেদন, জীবনের বহু ঝড় অতিক্রম করা এক নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। জিয়া পরিবারের প্রতি দোয়া অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাই এবং চিকিৎসা সেবায় যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানাই, যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
গামা আব্দুল কাদির সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশনের পাচঁবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অস্ট্রেলিয়া এবং আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখারও প্রধান উপদেষ্টা।