logo
মতামত

জীবন, একাকিত্ব ও সম্পর্কের মায়াজাল—এক পঞ্চাশোর্ধ নারীর আয়নায় আমাদের সমাজ

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা২৫ অক্টোবর ২০২৫
Copied!
জীবন, একাকিত্ব ও সম্পর্কের মায়াজাল—এক পঞ্চাশোর্ধ নারীর আয়নায় আমাদের সমাজ
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব শব্দটি হলো—একাকিত্ব। যে শব্দ কেউ শোনে না, কিন্তু প্রতিদিন নিজের ভেতরে মানুষ সেটার প্রতিধ্বনি টের পান। সুইডিস নারী ‘করিন’—বয়স ৫০, সেই প্রতিধ্বনির মাঝেই বেঁচে আছে। জীবনের নানা ঋতু তিনি পার করেছেন। প্রেম, সংসার, মাতৃত্ব, বিচ্ছেদ, দায়িত্ব ও অনিশ্চয়তা। আজ তার ঘরে আলো আছে, কিন্তু উষ্ণতা নেই; হাসি আছে, কিন্তু পরশ নেই। সন্তানেরা বড় হয়েছে, কিন্তু দূরে সরে গেছে। দিনের শেষে অফিস থেকে ফিরে করিন নিজের সঙ্গে কথা বলেন—‘এটাই কি জীবন? নাকি শুধু বেঁচে থাকা?’

সুইডেনের এই সমাজে কেউ একা থাকেন না, তবুও সবাই একা। এখানে মানুষ এখন সম্পর্ক খোঁজে অ্যাপে, ভালোবাসা নয়—মনোযোগ চার, কিন্তু প্রতিশ্রুতি নয়। করিনও শুরুতে ভাবেননি তিনি কখনো এমন করবেন, কিন্তু একদিন এক বন্ধু বললে, ‘Du måste leva, Karin—You have to live!’ এভাবেই শুরু তার নতুন অধ্যায়—Tinder, Match, Bumble, Hinge… স্ক্রিনের এক পাশে মুখ, অন্য পাশে আশা। শুরু হয় ছোট ছোট কথোপকথনে—‘Hi, how are you?’ ‘Nice picture.’ কিন্তু শব্দের নিচে লুকিয়ে থাকে এক বিশাল নীরবতা।

এক বিকেলে করিন বসেছিল এক কফি শপে। জানালার বাইরের তুষার গলে পানিতে পরিণত হচ্ছে, আর তার আঙুল কাপের গায়ে স্থির হয়ে আছে অনেকক্ষণ। অপর প্রান্তের মানুষটি নিজের সাফল্যের গল্প বলছে—করিন হালকা হেসে শুনছে, কিন্তু ভেতরে প্রশ্ন জাগে, ‘কেউ কি আজকাল ভালোবাসে, নাকি শুধু নিজেদের প্রমাণ করে?’

একদিন ডায়েরিতে লিখলেন তিনি—‘মানুষ এখন ভালোবাসে না; মানুষ এখন শুধু প্রমাণ খোঁজে যে তিনি এখনো আকর্ষণীয়।’ এমন এক সমাজে ভালোবাসা যেন বিনোদনের ধারাবাহিক পর্ব—একটি সিরিজ শেষ হলে, নতুন পর্বে চলে যাওয়া সহজ। কেউ কারও জীবন নয়, কেবল মুহূর্তের অভিনয়। হাসি, কফি, ছোঁয়া, তারপর নীরব প্রস্থান। যেখানে দেহের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু হৃদয়ের মুক্তি নেই। যেখানে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বার্তায়, শেষ হয় এক নিঃশব্দ ‘seen’ বা এক ‘block’-এ।

মানুষ আজ কথা বলে ইমোজিতে, ভালোবাসা মাপে ‘last seen’-এ, আর প্রতিশ্রুতি হারায় ওয়াই-ফাই সিগনালের মতো—যখন সংযোগ থাকে, তখনই সম্পর্ক থাকে। কিন্তু ভালোবাসা তো শুধু সংযোগ নয়, সংবেদন; এটি বিদ্যুৎ নয়, এটি আলো। আর সেই আলো নিভে গেলে মানুষ কেবল পথ হারায়, জীবনের অর্থ নয়। যে আলো নিভে গেলে ঘর অন্ধকার হয় না—মন অন্ধকার হয়।

তবু মানুষ বাঁচে, ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে। করিন জানে, কেউ আর ফিরে আসবে না। তবুও জানালার পাশে বসে তিনি সূর্যাস্ত দেখেন, যেখানে রং বদলায়, কিন্তু আলো হারায় না। তার মনে হয়, সম্ভবত ভালোবাসা শেষ হয়নি—শুধু রূপ পাল্টেছে। আর সেই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেন, আল্লাহ/ঈশ্বরের আলো কখনো নিভে যায় না। কিন্তু করিনের হৃদয় এখনো পুরনো ধারার—তিনি ভালোবাসলে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন, ভুললে কাঁদেন, কাঁদলেও কাউকে বলেন না। তার চোখে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে এক পুরুষের মুখ, যার প্রতি একসময় ছিল না কোনো আকর্ষণ, কিন্তু আজ হঠাৎ চোখে জমে থাকা দৃষ্টিতে কিছু একটার অনুরণন টের পান। তার চোখ নেমে আসে নিচে, কিন্তু মন বলে—‘এটা কি পাপ, নাকি কেবল মানবতা?’

ইসলাম ধর্মের হাদিসে বলা আছে—‘চোখেরও যিনা আছে’। কিন্তু সেই চোখ যদি সেজদার সময়ও স্মৃতির ছায়া দেখে, তাহলে বুঝতে হয়—আত্মা এখনো পুরোপুরি পরিশুদ্ধ হয়নি। এমনই এক সময় করিনের শেষ জার্নাল নোটে ধরা পড়ে এই উপলব্ধি—তবুও মানুষ খোঁজে ভালোবাসা, যেমন মরুভূমি খোঁজে একফোঁটা পানি।

কারণ যতই প্রযুক্তি বাড়ুক, ভালোবাসা ও তওবা—এই দুটি অনুভূতি চিরন্তন। একটি মানুষকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখে, অন্যটি আল্লাহ/ঈশ্বরের দরজায় ফিরিয়ে আনে। কিন্তু এই পশ্চিমা প্রাচুর্যের মধ্যেও এক ভয়াবহ শূন্যতা আছে—প্রতিদিন মানুষ হাসে, কিন্তু অন্তরে কাঁদে। প্রতিদিন কেউ নতুন সম্পর্কে যায়, আবার একা ঘরে ফিরে নিঃশব্দে টিভি দেখে ঘুমিয়ে পড়েন। এই সমাজে কেউ আত্মহত্যা করেন না, শুধু দারিদ্র্যে নয়—বরং ভালোবাসার অভাবে, সংলাপের অভাবে, অর্থহীন এক ‘কমফোর্ট’-এর অতিরিক্ততায়।

করিনের গল্প তাই কেবল একজন নারীর নয়—এটি আমাদের যুগের গল্প। যেখানে সবকিছু উন্মুক্ত—চিন্তা, সম্পর্ক, মত, শরীর—কিন্তু হৃদয়টি আজও বন্দী। আর তখনই মনে পড়ে যায় কোরআনের সেই আয়াত—‘প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং আমি তোমাদের পরীক্ষা করব সুখ ও দুঃখের মাধ্যমে।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৫)

তাহলে প্রশ্ন করি—আমরা কাকে খুশি করতে বাঁচছি? মানুষকে, সমাজকে, নাকি নিজের রবকে?
একদিন এই পৃথিবী থেকে চলে গেলে যে চেয়ারটিতে বসে লিখছি, সেখানে বসবে অন্য কেউ, যে বিছানায় ঘুমাচ্ছি, সেখানে শোবে নতুন দেহ। নাম থাকবে কিছুদিন, তারপর হারিয়ে যাবে সময়ের ভেতরে। তবু মানুষ বাঁচে, ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে—কারণ এই জীবন এক নিঃশ্বাসের চেয়েও ক্ষণিক, তবুও এক অলৌকিক পরীক্ষাগার, যেখানে প্রত্যেক নিঃশ্বাসে আল্লাহ আমাদের ডাকছেন—‘আমার দিকে ফিরে এসো।’ তাই জীবন কেবল একাকিত্ব নয়, জীবন এক শিক্ষা—যে ভালোবাসা আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয়, তা প্রেম নয়; যে একাকিত্ব আল্লাহর কথা মনে করায়, সেটাই মুক্তি।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

আরও দেখুন

ব্যাংকিং খাতে গভীর ক্ষত: বাংলাদেশ কি পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে পাবে?

ব্যাংকিং খাতে গভীর ক্ষত: বাংলাদেশ কি পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে পাবে?

জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো সংস্কার সফল হবে না। যেকোনো অনিয়ম প্রকাশ পেলে দ্রুত তদন্ত, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এগুলো শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং এক ধরনের মানসিক বার্তাও তৈরি করে যে অপরাধী রেহাই পায় না। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রধান শক্তি ছিল বিচারহীনতা।

১১ ঘণ্টা আগে

ফ্রান্সের পথে পথে: যেদিন আইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল

ফ্রান্সের পথে পথে: যেদিন আইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল

১৯২০-এর দশকে ইউরোপ তখন যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতায় কাঁপছে। আইফেল টাওয়ার তখনো এতটা জনপ্রিয় নয়। রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বাড়ছে, আর শহরে গুজব—টাওয়ারটা নাকি ভেঙে ফেলা হতে পারে। এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন বিশ্বখ্যাত প্রতারক ভিক্টর লাস্টিগ।

১১ ঘণ্টা আগে

খালেদা জিয়ার প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবং নীরব শক্তির প্রতিচ্ছবি

খালেদা জিয়ার প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবং নীরব শক্তির প্রতিচ্ছবি

এই সময় আমরা যে প্রার্থনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছি তা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি এক মানবিক আবেদন, জীবনের বহু ঝড় অতিক্রম করা এক নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। জিয়া পরিবারের প্রতি দোয়া অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাই এবং চিকিৎসা সেবায় যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানাই, যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন।

১৩ ঘণ্টা আগে

অনন‍্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা গামা আব্দুল কাদির

অনন‍্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা গামা আব্দুল কাদির

গামা আব্দুল কাদির সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশনের পাচঁবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অস্ট্রেলিয়া এবং আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখারও প্রধান উপদেষ্টা।

৫ দিন আগে