logo
মতামত

রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক সংস্কার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার অপরিহার্য হাতিয়ার

সহিদুল আলম স্বপন
সহিদুল আলম স্বপন৩০ অক্টোবর ২০২৫
Copied!
রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক সংস্কার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার অপরিহার্য হাতিয়ার
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি এবং রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে শুধু প্রবৃদ্ধির হার বা পরিমাণ দেখলেই হয় না। এর মূল ভিত্তি হলো রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক খাতের নীতি-পরিকল্পনার স্থায়িত্ব। বাস্তবতা হচ্ছে, একটি দেশের সরকার যদি রাজস্ব সংগ্রহে সক্ষম না হয় এবং আর্থিক খাতের সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদে ভঙ্গুর হয়ে পড়তে বাধ্য।

বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের বর্তমান অবস্থা যে পর্যায়ে রয়েছে, তা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। কর নির্ভর রাজস্বের কম বিস্তার এবং কর ব্যবস্থার জটিলতা দেশের অর্থনীতিকে যথাযথভাবে সমর্থন করতে পারে না। একটি শক্তিশালী আর্থিক মেরুদণ্ড গঠনের জন্য প্রয়োজন মূলত তিনটি স্তরে সংস্কার: প্রথম, কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন; দ্বিতীয়, কর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি হ্রাস এবং তৃতীয়, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, রাজস্ব খাতের সংস্কার ছাড়া আর্থিক খাতের উন্নয়নও অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

রাজস্ব খাতের উন্নয়ন অর্থনীতির প্রতিটি স্তরকে প্রভাবিত করে। সরকার পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারলে তা বিনিয়োগ, সামাজিক সেবা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বৈদেশিক ঋণ হ্রাসে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে, কম রাজস্ব আহরণ সরকারের ওপর ঋণ নির্ভরতা বাড়ায় এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস করে। এটি প্রমাণ করে, রাজস্ব খাতের সংস্কার শুধু কর আদায় বাড়ানোর জন্য নয়, বরং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য।

রাজস্ব খাতের সংস্কার প্রধানত তিনটি দিক থেকে বিবেচনা করা যায়। প্রথমত, কর ব্যবস্থা এবং নীতিমালা সরলীকরণ। যেসব প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক যথাযথভাবে কর দিতে প্রস্তুত, তাদের জন্য প্রক্রিয়াটি সহজ ও স্বচ্ছ হওয়া উচিত। কর প্রদানে ফাঁকফোকর রোধ করতে ডিজিটালাইজেশন ও তথ্যভিত্তিক নজরদারি অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, কর নির্ভর রাজস্বের বিস্তার বাড়ানো। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজস্বের একটি বড় অংশ আসে কনজামশন এবং আয়কর থেকে। তবে উন্নত ও বৈচিত্র্যময় কর নীতি গ্রহণ করা হলে আরও বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব। তৃতীয়ত, কর ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি হ্রাস। এটি সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ করদাতাদের আস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো কর নীতি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয় না।

আর্থিক খাতের সংস্কারও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করতে হবে। নীতি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ঋণ ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে, ব্যাংকগুলোর ওপর সরকারি নজরদারি, শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা অপরিহার্য। যদি রাজস্ব খাত ও আর্থিক খাত একসঙ্গে শক্তিশালী হয়, তখনই দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সত্যিকারের স্থায়িত্ব পায়।

বাংলাদেশের উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যেখানে কর আহরণ বাড়াতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং আর্থিক খাতের নীতি-সংস্কার করা হয়েছে, সেখানে অর্থনীতি দ্রুত সমৃদ্ধ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভ্যাট ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন এবং ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছ নিয়ন্ত্রণ দেশকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। তবে, এই প্রক্রিয়া এখনো আংশিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে সম্পূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারছে না।

রাজস্ব আহরণ এবং আর্থিক খাতের সংস্কার দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে একটি লিনিয়ার প্রভাব ফেলে না। বরং এরা একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত। যথাযথ রাজস্ব আহরণ ছাড়া ব্যাংকিং খাত বা বিনিয়োগ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করা কঠিন। একইভাবে, যদি আর্থিক খাত দুর্বল থাকে, সরকার কর আয় সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না এবং অর্থনীতি এক ধরণের অস্থিতিশীল চক্রে প্রবেশ করবে। এই দ্বৈত সংস্কারই নিশ্চিত করে যে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দৃঢ়, স্বনির্ভর এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।

এ ছাড়াও, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকেও রাজস্ব সংগ্রহ ও আর্থিক খাতের সংস্কার অপরিহার্য। কর ব্যবস্থা যদি স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়। একইভাবে, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। এই আস্থা হলো অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটি অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী চালিকা শক্তি।

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য রাজস্ব খাত ও আর্থিক খাতের সংস্কারকে সংহতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এটি শুধুমাত্র উন্নয়নের জন্য নয় বরং দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা এবং সরকারী নীতি-পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন একসঙ্গে না হলে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কখনোই প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হতে পারবে না।

অতএব, আমরা বলতে পারি যে, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ও আর্থিক খাতের সংস্কারই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থায়ীভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে। এগুলো ছাড়া শুধু জিডিপির হার বা রপ্তানি বৃদ্ধি দেখালেই যথেষ্ট নয়। দেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক কল্যাণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কার অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ, নীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এক কথায়, রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক খাতের সংস্কারই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করার চাবিকাঠি।

(মতামত লেখকের নিজস্ব

*লেখক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট ও কবি

আরও দেখুন

ব্যাংকিং খাতে গভীর ক্ষত: বাংলাদেশ কি পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে পাবে?

ব্যাংকিং খাতে গভীর ক্ষত: বাংলাদেশ কি পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে পাবে?

জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো সংস্কার সফল হবে না। যেকোনো অনিয়ম প্রকাশ পেলে দ্রুত তদন্ত, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এগুলো শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং এক ধরনের মানসিক বার্তাও তৈরি করে যে অপরাধী রেহাই পায় না। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রধান শক্তি ছিল বিচারহীনতা।

১১ ঘণ্টা আগে

ফ্রান্সের পথে পথে: যেদিন আইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল

ফ্রান্সের পথে পথে: যেদিন আইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল

১৯২০-এর দশকে ইউরোপ তখন যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতায় কাঁপছে। আইফেল টাওয়ার তখনো এতটা জনপ্রিয় নয়। রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বাড়ছে, আর শহরে গুজব—টাওয়ারটা নাকি ভেঙে ফেলা হতে পারে। এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন বিশ্বখ্যাত প্রতারক ভিক্টর লাস্টিগ।

১১ ঘণ্টা আগে

খালেদা জিয়ার প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবং নীরব শক্তির প্রতিচ্ছবি

খালেদা জিয়ার প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবং নীরব শক্তির প্রতিচ্ছবি

এই সময় আমরা যে প্রার্থনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছি তা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি এক মানবিক আবেদন, জীবনের বহু ঝড় অতিক্রম করা এক নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। জিয়া পরিবারের প্রতি দোয়া অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাই এবং চিকিৎসা সেবায় যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানাই, যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন।

১৩ ঘণ্টা আগে

অনন‍্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা গামা আব্দুল কাদির

অনন‍্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা গামা আব্দুল কাদির

গামা আব্দুল কাদির সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশনের পাচঁবার সভাপতি এবং তিনবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, অস্ট্রেলিয়া এবং আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখারও প্রধান উপদেষ্টা।

৫ দিন আগে